তিনি একসময় ছিলেন অচেনা নাম। পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্তের নিচে, জীবন যাপন ছিল চরম অনিশ্চয়তায় ঘেরা। অথচ আজ পারভেজ হাওলাদার পরিচিত খুলনার রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম আলোচিত নাম হিসেবে। ছাত্ররাজনীতির ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক তরুণ কীভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন—সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দলীয় নেতৃত্ব এবং সাধারণ জনমনে।
২০১৭ সালের ২৯ জুলাই, পারভেজ হাওলাদার হন খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। এর ঠিক কিছুদিন পরেই পারভেজের পিতা আলম হাওলাদার কিডনি দান করেন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজাকে। স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, এই কিডনি দানের পেছনে লুকিয়ে ছিল রাজনৈতিক বিনিময়ের অজানা সমীকরণ। অভিযোগ অনুযায়ী, কিডনি দান করে পারভেজের পরিবার কামিয়ে নেয় কয়েক কোটি টাকা, যা দিয়ে রাজনীতির জোরদার ভিত গড়ে তোলেন।
সুজার মৃত্যুর পর রাজনীতিতে পালাবদল হয়। মনোনয়ন পান সালাম মূর্শেদী। পারভেজ ও তার পিতা তখন নতুন করে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সালাম মূর্শেদীর সঙ্গে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সফরে তাদের হেলিকপ্টারে উঠতে দেখা যায়—যা রীতিমতো আলোচনার জন্ম দেয়।
দলীয় কমিটি গঠনে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ নতুন নয়, তবে পারভেজ হাওলাদারকে নিয়ে ওঠা অভিযোগগুলো তুলনামূলক বেশি জোরালো। জেলা ছাত্রলীগের ২৩১ সদস্যের কমিটি গঠনের সময় পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ নেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। পরবর্তীতে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনেও একই প্রক্রিয়ায় অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
এই অর্থ দিয়ে কোথায় কী বিনিয়োগ হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে চোখে পড়ার মতো কিছু স্থাপনার কথা জানা গেছে—যেমন খুলনা সেন্টাল রোডের পাশে গড়ে ওঠা ‘অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ এবং বাজের ব্যবসার জন্য কেনা পল্টন। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, শেখ বাড়ি তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাত ভাই শেখ সোহেলের দালালী করে পারভেজ হাওলাদার ভারতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
গত বছরের ৪ আগস্ট খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ছাত্র ও সাধারণ জনতার হাতে মারধরের শিকার হন পারভেজ হাওলাদার। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তার প্রতি সহানুভূতির জোয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই তাকে ‘নির্যাতিত নেতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে, এ নিয়েও উঠছে ভিন্ন মত। একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, পারভেজ আগেই হামলার তথ্য পেয়েছিলেন, কিন্তু তবুও পার্টি অফিসে ঢোকেন—কারণ, একাংশ মনে করে এই ঘটনার মাধ্যমে ‘হিরো’ ইমেজ তৈরি করা হয়েছিল সচেতনভাবে।
এমনকি অভিযোগ রয়েছে, ৪ আগস্টের এই “আহত হওয়ার নাটক” দেখিয়ে পারভেজ হাওলাদার কয়েক লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেন। সাবেক সহযোগীদের ভাষায়—“পিটুনি খেয়ে সে হিরো হয়ে গেল, আর এই হিরো ইমেজ বেচে কামিয়ে নিল কোটি কোটি টাকা।”
হামলার পর থেকেই পারভেজ হাওলাদার খুলনা থেকে সরে যান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই পরিচালনা করছেন ভাঙারির ব্যবসা। অন্যদিকে, তার ডানহাত হিসেবে পরিচিত আশিক তানভীর দেশ ছেড়েছেন এবং এখন রয়েছেন মালয়েশিয়ায়। যারা মাঠে কাজ করতেন, তারা এখন নিঃস্ব, অনেকে পালিয়ে দিন কাটাচ্ছেন অনিশ্চয়তায়। একজন বলেন, “কমিটি বানালাম, মিছিল করলাম, পোস্টারে ছবি দিলাম—কিন্তু আজ খাওয়ারও জায়গা নাই। পারভেজ আমাদের ফোনও ধরে না।”
পারভেজ হাওলাদারের বাংলাদেশি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার কোনো সামাজিক মাধ্যমেও সাম্প্রতিক সময়ে কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি।
তার গ্রামের বাড়ি খুলনার সিংহেরচর এলাকায় গিয়ে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, “এই পরিবার রাজনীতিকে শুধুই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। গরিবের পাশে থাকেনি কখনো।” তারা আরও জানান, ৫ আগস্টের ঘটনার পর পারভেজের পিতা আলম হাওলাদার নাকি এক বিএনপি নেতার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উল্টো সেখান থেকে মার খেয়ে পুলিশে দেওয়া হয়।
ছাত্রনেতা হিসেবে শুরু, এরপর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, বিতর্কিত অর্থ উপার্জন, সম্পদ গঠন, মারধরের শিকার হয়ে হিরো ইমেজ—সব মিলিয়ে পারভেজ হাওলাদারের গল্প যেন এক নাটকীয় চিত্রনাট্য। তবে এই চিত্রনাট্যে আছে অজস্র অসংগতি, অভিযোগ আর অসন্তোষের ছাপ। তার উত্থান যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি সেই উত্থানের পথে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রশ্ন, যার উত্তর পাওয়া এখন সময়ের দাবি।