ছাত্রশিবিরে আমার দিনগুলো
শৈশবের অনেক স্মৃতি আজও মনের কোণে রঙিন হয়ে আছে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকলেও রাজনীতি বা সংগঠনের কোনো খবরই জানতাম না। আমার প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন ইসলামী ছাত্র শিবিরের দায়িত্বশীল, তবে তিনি কখনো এ বিষয়ে আলোচনা করতেন না।
এক বিকেলে স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনা চলছিল। হঠাৎ এক অচেনা লোক সাইকেলে এসে স্যারের সাথে কথা বলতে লাগলেন। কথার ফাঁকে তিনি আমার দিকেও তাকালেন, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন— কোন ক্লাসে পড়ি, রোল কত? আমি উত্তর দিলাম। স্যার মুচকি হেসে বললেন— ইবনে আলম খুব মেধাবী, উপজেলা সদরের মেধাবীদের সাথেও পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা করে।
কিছুক্ষণ পর সেই আগন্তুক আমাকে একটি রিপোর্ট পেপার দিলেন। বললেন— প্রতিদিন কত ঘণ্টা পড়াশোনা করো, কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়ো, কতক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করো—এসব লিখে রাখবে। মাস শেষে স্যারের হাতে জমা দেবে।
কেন জানি না, কিন্তু তখন আমার ভেতরে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। মনে হলো, কেউ আমাকে ভালো কাজের পথে উৎসাহিত করছে। এরপর থেকেই আমি নিয়মিত নামাজ-কালাম শুরু করি এবং রিপোর্ট পেপারে নিজের প্রতিদিনের হিসাব লিখতে থাকি। পরে জানতে পারি, সেই আগন্তুক ছিলেন তৎকালীন রূপসার একাংশের সভাপতি ভাই।
দিন কেটে যায়। একদিন দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে দেখি—সভাপতি ভাই, স্যারসহ কয়েকজন মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। আমি লজ্জায় পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সভাপতি ভাই হঠাৎ আমাকে সালাম দিলেন। বয়সে বড় কেউ ছোটকে সালাম দেয়—তখন আমার কাছে সেটাই ছিল অদ্ভুত ও আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তিনি কয়েকটি সাধারণ বিষয়ে কথা বললেন, আমি ভেতরে ভেতরে আলোকিত বোধ করলাম।
এভাবেই দিন মাসে, মাস বছরে গড়িয়ে যায়। আমি ধীরে ধীরে শিবিরের দায়িত্বশীল হয়ে উঠি। প্রতি শুক্রবার বিকেল তিনটায় একটি পরিত্যক্ত দোকানের পেছনে আমাদের ছোট্ট মিটিং বসত। সবার জন্য বিস্কুট থাকত—সেই বিস্কুট যেন ছিল একতার প্রতীক। বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে, ভয়ের মাঝেও, সেই মিটিংগুলো আজও মনে পড়ে যায়।
২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ছিল আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এডভোকেট পলাশ ভাই জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। আমরা তার জন্য প্রাণপণ কাজ করি। কিন্তু হঠাৎ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। সেদিন বুকভরা কষ্ট নিয়ে বুঝেছিলাম—রাজনীতির পথ সহজ নয়।
ক্রমে আমি ওয়ার্ড শিবিরের সেক্রেটারি, সভাপতি এবং অবশেষে উপশাখার সভাপতির দায়িত্বও পালন করি। কিন্তু সময়ের সাথে কিছু দায়িত্বশীলের আচরণে মন ভেঙে যায়। সেই কষ্ট আমাকে ধীরে ধীরে শিবির থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।
আজও মনে হয়, জীবনের প্রথম রাজনীতি শুরু হয়েছিল শিবিরের হাত ধরে। বহু ত্যাগ, লুকোচুরি, সংগ্রাম আর পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও পথচলা ছিল একরকম যুদ্ধের মতো।
শিবিরে কাটানো দিনগুলো আজও আমার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। হয়তো সংগঠনের পথ থেকে সরে এসেছি, কিন্তু সেই সময়ের অভিজ্ঞতা, মানুষের ভালোবাসা, অদম্য সাহস—এসবই আমার জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরদিন।
No comments